দেশের অন্যান্য জেলার মতো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মানিকগঞ্জ জেলার রাজনীতিও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপির পাশাপাশি অন্য দলগুলোর মনোনয়নপ্রত্যাশীরা সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের নিজের পক্ষে আকর্ষণ করতে চষে বেড়াচ্ছেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী মানিকগঞ্জ জেলায় আসন ছিল চারটি। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে চারটি আসনেই জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। তবে এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি আসন কখনো বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। পুনর্বিন্যাসের ফলে ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জের চারটি আসন কমে হয় তিনটি। ওই বছরের নির্বাচনে তিনটি আসনই পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও একই ধারা অব্যাহত থাকে।
মানিকগঞ্জে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গোছানো আওয়ামী লীগ রয়েছে ফুরফুরে মেজাজে। যোগ্য অনেক নেতা বাদ পড়ার অভিযোগের পরও জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত রয়েছে আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। গত ১০ বছরের অব্যাহত উন্নয়ন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সুসংহত সাংগঠনিক শক্তি, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান হাতিয়ার হবে বলে মনে করে নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীরা মনে করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেসব অপপ্রচার ছিল গত ১০ বছরে তা অনেকটা কেটে গেছে। নতুন প্রজন্ম এখন আর ওই সব অপপ্রচারে বিশ্বাস করে না। তবে আগামী নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে এই জেলায় কিছুটা অস্বস্তি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছে দলটির নেতাকর্মীরা। দল আবার ক্ষমতায় আসবে এমন হিসাব কষেই মানিকগঞ্জের তিনটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে একসময় মানিকগঞ্জকে বলা হতো বিএনপির ঘাঁটি। কিন্তু গত ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা জেলা বিএনপিতে নেতৃত্বের কোন্দলে দলটি রয়েছে ব্যাকফুটে। প্রায় চার বছর আগে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১৬ সদস্যের জেলা কমিটি গঠন করা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি দলটি। আবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে রয়েছে বিভাজন। যে কারণে সভাপতি উপজেলা কমিটি গঠন করলেও অন্যপক্ষ তা মেনে নেয়নি। ১৬ সদস্যের কমিটির সবাই মিলে এ পর্যন্ত একটিও মিটিং করতে পারেনি। যে কারণে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপি সাংগঠনিক সংকটে রয়েছে। নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে এই সংকট আরো বাড়বে বলে মনে করছে দলটির নেতাকর্মীরা। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা না থাকায় অনেকে আগামী নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হতে চাইছেন না। তবে নেতাকর্মীদের দাবি, সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলেও জনসমর্থনে তা কাটিয়ে উঠবে দলটি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনটি আসনই পুনরুদ্ধার করতে পারবে তারা।
মানিকগঞ্জ-১ (শিবালয়-ঘিওর-দৌলতপুর)
আওয়ামী লীগ
মানিকগঞ্জ-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের নাঈমুর রহমান দুর্জয়। আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন চাইবেন জাতীয় দলের সাবেক এই ক্রিকেটার। এরই মধ্যে দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের নিয়ে তিনি প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে এ আসন থেকে তাঁর পাশাপাশি মনোনয়ন চাইছেন আরো চারজন। তাঁরা হলেন—জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম জাহিদ, এই আসন থেকে ২০০৮ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল হক এবং মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার সুভাষ চন্দ্র সরকার। এই চারজনই মনোনয়ন চাইবেন বলে কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশী এই চারজনও নির্বাচনী মাঠে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। চারজনকেই প্রতিদিন এলাকায় জনসংযোগে ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে।
বিএনপি
এই আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে চারজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তাঁরা হলেন—জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য এস এ জিন্নাহ কবীর, বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে জেলা বিএনপির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার আব্দুল হামিদ ডাবলু, আরেক ছেলে জেলা বিএনপির কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ড. খন্দকার আকবর হোসেন বাবলু, দৌলতপুর উপজেলা চেয়ারম্যান তোজাম্মেল হক তোজা। তবে বর্তমানে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে প্রার্থী মনোনয়ন জটিল হলে স্বয়ং খালেদা জিয়া এই আসনে নির্বাচন করতে পারেন বলে দলের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে।
মানিকগঞ্জ-২ (সিংগাইর-হরিরামপুর)
আওয়ামী লীগ
মানিকগঞ্জ-২ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা শামসুদ্দীন আহম্মেদ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক ক্রীড়া ও যুব বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও হাটিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মনির হোসাইন, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য আব্দুস সালাম চৌধুরী। এ ছাড়া ২০০৮ সালে এই আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম আব্দুল মান্নানও মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। আব্দুল মান্নান জানান, মহাজোটে থাকার কারণে দলের সিদ্ধান্তে গত নির্বাচনে তিনি সরে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে তিনি নিজ এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। মহাজোট হয়ে নির্বাচন হলে এই আসনে তাঁর মনোনয়ন নিশ্চিত বলে তিনি দাবি করেন।
এ ছাড়া ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে নির্বাচিত সংসদ সদস্য গোলাম সারোয়ার মিলনও এবার নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে। দলের মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন তিনি।
বিএনপি
এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মাঈনুল ইসলাম খান শান্ত। তবে তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সিংগাইর উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আবিদুর রহমান খান। জেলা বিএনপিতে দুজনের অবস্থান দুই মেরুতে। মাঈনুল ইসলামের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। আবিদুর রহমান সিংগাইর উপজেলা বিএনপির একাংশের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজেকে দাবি করেন। দলের ভেতরে আবিদুর রহমানের জনপ্রিয়তা তাঁকে পাইয়ে দিতে পারে বিএনপির মনোনয়ন। তবে মাঈনুল ইসলাম শান্তর বাবা সাবেক শিল্পমন্ত্রী প্রয়াত শামসুল ইসলাম খানের প্রতি খালেদা জিয়ার কৃতজ্ঞতা সূত্রে শান্তর মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত বলে জানান তাঁর সমর্থকরা। এ আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খানম রিতাও মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে আবিদুর রহমান জানান, রিতাকে মনোনয়ন দিলে তিনি আপত্তি করবেন না।
মানিকগঞ্জ-৩ (মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া)
আওয়ামী লীগ
মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রার্থী বর্তমানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন। তাঁর সময়কালে মানিকগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ডায়বেটিক হাসপাতাল, নার্সিং ইনস্টিটিউট, কালীগঙ্গা ব্রিজসহ বহু উন্নয়ন হয়েছে। এবারও এই আসন থেকে প্রার্থী হচ্ছেন বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি। তবে এ আসন থেকে দেশের নামকরা বড় দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দুজন শিল্পপতি মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল ইসলাম খান বাবলু, শিল্পবিষয়ক সম্পাদক এফবিসিসিআই পরিচালক তাবারাকুল তোসাদ্দেক হোসেন খান টিটু, আমেরিকাপ্রবাসী ড. রফিকুল ইসলাম ও মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে জানা গেছে।
এদিকে জেলা জাসদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন খানও দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন। ১৪ দল জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে তিনি এই আসনে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী বলে জানিয়েছেন।
বিএনপি
এই আসনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন চাইবেন জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন মানিকগঞ্জ-২ (সিংগাইর-হরিরামপুর) আসনে। এই আসন থেকে আরো মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট জামিলুর রশিদ খান, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা। এরা দুজনই মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। তাঁরা জানান, এই আসনে আফরোজা খানম রিতা মনোনয়ন চাইতে পারেন না। কারণ এর আগে তিনি মানিকগঞ্জ-২ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন।