সাংবাদিক:মোঃ সবুজ হোসেন:
আত্মহত্যার আগে – স্কুলে ডেকে নিয়ে বাবাকে অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারী। আত্মহত্যার কিছুক্ষণ আগে অরিত্রি তার মাকে বলেছিল, মা এ লজ্জা নিয়ে আমি বাঁচতে চাই না।
অরিত্রির বিরুদ্ধে স্কুল কর্তৃপক্ষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নকলের অভিযোগ এনেছিল। এজন্য অরিত্রির মা-বাবাকে ডেকে নেন ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ।
তাদের ডেকে মেয়ের সামনেই অপমান করে বলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে অরিত্রিকে নকলের অভিযোগে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়া হবে। এ অপমান সইতে না পেরে বাসায় এসে অরিত্রি আত্মহত্যা করে।
পুলিশ ও পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার বেলা সাড়ে ১২টায় রাজধানীর শান্তিনগরে সাততলা ভবনের সপ্তম তলায় নিজ ফ্ল্যাটের ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় অরিত্রিকে পাওয়া যায়।
এর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে চিকিৎসকরা অরিত্রিকে মৃত ঘোষণা করেন।
ওই ছাত্রীর গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। অরিত্রির বাবা দিলীপ কুমার একজন সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী।
এদিকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেয়া এবং স্কুলে ডেকে বাবা-মাকে অপমান করায় ছাত্রী অরিত্রি অধিকারী আত্মহত্যার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস।
তিনি দেশবাসী ও ছাত্রীর বাবা-মায়ের প্রতি ক্ষমা চেয়েছেন।
মঙ্গলবার বেলা ১১টায় স্কুলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি খুব দুঃখজনক ঘটনা, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমাদের একজন ছাত্রীর মৃত্যু হল- সে জন্য আমরা সবাই ক্ষমা প্রার্থী। ছাত্রীর বাবা-মায়ের কাছেও আমি ক্ষমা চাচ্ছি।
এখন ক্ষমা চেয়ে কি লাভ?
অভিভাবক ডেকে ছাত্রীর সমানে তাদের তীব্র অপমান করা হয়েছে। পিতা-মাতার এমন অপমানিত হওয়া মেনে নিতে পারেনি, আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই আবার অভিভাবক ডেকে ক্ষমা চাওয়াটাকে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই বলা যায়না।
মাত্র গতকালই ঘটে গেছে এই হৃদয়বিদারক ঘটনা। একে অপরাধ বললেও অনেকখানি কম বলা হবে। সঙ্গে মোবাইল থাকায় ভিকারুননিসা নুন স্কুলের শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারীর অভিভাবককে ডেকে অপমান করে টিসি দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এই অপমান মেনে নেওয়ার সম্ভব হয়নি অরিত্রির। তাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া।
স্কুলে মোবাইল নিয়ে যাওয়া নিষেধ, তারপরেও কেন তার কাছে ফোন ছিল- এটাই ছিল অপরাধ। এই অপরাধের নির্দিষ্ট পদক্ষেপ অবশ্যই ছিল। কিন্তু বিষয়টি ভাইস প্রিন্সিপাল থেকে প্রিন্সিপাল পর্যন্ত গড়ায়। তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া হলেও প্রিন্সিপাল সদয় হননি। প্রায় পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেও সেই প্রিন্সিপাল তাদের বেরিয়ে যেতে বলেন। তিনি অরিত্রিকে টিসি (ছাড়পত্র) দেওয়ারও নির্দেশ দেন।
এই যে অভিভাবক ডেকে তাদের সামনে এত বড় অপমান, স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি- এই বিষয়টি কখনোই মেনে নেওয়ার মতো নয়। মাত্র নবম শ্রেণীতে পড়া উঠতি বয়সের একটি মেয়ে কতটা অপমানিত হলে নিজেকে শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা বোঝার ক্ষমতা আমাদের আছে।
অভিভাবকরা সন্তানদের শুধু লেখাপড়ার উদ্দেশ্যেই পাঠায় না। সব ধরনের শিক্ষাদীক্ষা, শিষ্টাচারও স্কুল থেকে শিখে সুনাগরিক হবে তারা, সেটাই নিয়ম। সে যদি সেখানে কোনো ভুল করে, তার সংশোধনের পথও আছে। হুট করে টিসি দিয়ে বের করে দেওয়া হবে, এটা কোনো সমাধান নয়। তার ওই পরীক্ষার খাতাটিই বাতিল করে দিতে পারতো তারা, ওই পরীক্ষায় অকৃতকার্য করে দিতে পারতো, তাকে সতর্ক করে দিতে পারতো। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এটা বোর্ড পরীক্ষার মতো কোনো বড় পরীক্ষাও ছিল না যে তাদের এতটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো।
দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভিকারুননিসার নাম উঠে আসবেই। সবাই জানে এই প্রতিষ্ঠানে যারাই পড়বে, তারা অবশ্যই মেধাবী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অরিত্রি বিজ্ঞান শাখায় ছিল এবং তার ক্রমিক সংখ্যা ছিল ১২। সে যে আসলেই মেধাবী সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। তাকে সেভাবে এককথায়, এক নোটিশে বের করে দেওয়া হবে কেন? এমন যদি হতো যে কোনো শিক্ষার্থী বার বার ভুল করে, তাকে ছাড়পত্র দেওয়ার একটা যুক্তি আমরা মেনে নিতে পারি।
২০১২ সালের বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে দেওয়া নির্দিষ্ট নির্দেশিকা অনুযায়ী, একজন শিক্ষার্থীকে বার বার সংশোধন করতে বলতে হবে। পারতপক্ষে তাকে টিসি দেওয়া যাবে না। তাকে কোনো শারীরিক মানসিক নিপীড়ন করা যাবে না। সেখানে স্কুলটির প্রিন্সিপাল যে এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটা তো ফৌজদারি অপরাধের সামিল। এখন তিনি ক্ষমা চেয়ে অপরাধের স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু যেই অভিভাবকের সামনে তাদের সন্তানকে এমন অপদস্ত হতে হলো, যেই অভিভাবক তাদের সন্তানকে এজন্য চিরদিনের মতো হারালো, তাদের কাছে এখন ক্ষমা চেয়ে আসলে কি কোনো লাভ বা সমাধান আছে? এটা কি একজন শিক্ষকের আদর্শের মধ্যে পড়ে?
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ মোঃ পলাশ শিকদার