যে জয়ের উপরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
এ,এইচ,এম নাইমঃ
স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনাল জিতে বাংলাদেশ জাতীয় দল নিশ্চিত করেছে যে, নিরানব্বই এর বিশ্বকাপে যে তিন সহযোগী দেশ অংশগ্রহণ করবে তাদের মধ্যে অন্যতম যারা। দেশজুড়ে আনন্দের মিছিল। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সারাদেশ ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ স্লোগানে মুখরিত। কিন্তু অতি আনন্দের মাঝে ঘটে যায় কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা। বাংলাদেশের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার আনন্দ উদযাপন করতে গিয়ে ঘটে যায় হতাহতের ঘটনাও। আনন্দ আর দুঃখের দোলাচলে ভাসা জাতির জন্য কিছু করতেই হত টাইগারদের৷ টাইগারদের সেই কীর্তি নিয়েই আজকের আয়োজন।
মালয়েশিয়ার কিলাত কেলাব মাঠে ফাইনালে মুখোমুখি কেনিয়া ও বাংলাদেশ। মালয়েশিয়ার আবহাওয়া কেমন যেন রহস্যময়। রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি নয়, বৃষ্টি নামলে আর থামাথামির নাম নেই। কেনিয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বেশ ভালো ধারণা আছে, কারণ পরস্পরের বিপক্ষে বেশ ক’বার খেলেছে তারা। প্রথমে ব্যাট করে কেনিয়া তাদের নির্ধারিত ৫০ ওভারে তোলে ৭ উইকেটে ২৪১ রান। মনে রাখতে হবে, সে সময়টা ধুন্ধুমার টি২০ এর যুগ ছিলোনা। ২৪০-২৫০ এর স্কোরগুলো অনেক সময়ই ম্যাচজয়ী স্কোর হত। সারাদেশের মানুষ দুশ্চিন্তায়, ফাইনালে এত রান তাড়া করতে পারবে তো বাংলাদেশ?
কপালের ভাঁজ আরো বাড়িয়ে দিল বৃষ্টি। আগেই বলেছি মালয়েশিয়ার আবহাওয়ার কথা। বৃষ্টি থামাথামির নামগন্ধ নেই। বৃষ্টি থামলে এত তাড়াতাড়ি মাঠ শুকানোরও বালাই নেই৷ অগত্যা ম্যাচ গড়ালো রিজার্ভ ডে তে।
পরের দিনও খেলা শুরু হতে হতে বেশ দেরি হয়ে যায়। বাংলাদেশের সামনে বৃষ্টি আইনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৫ ওভারে ১৬৬। অর্থাৎ ১৫০ বলে ১৬৬। ওভারপ্রতি ৬ এর বেশি। এখনকার যুগে সহজ হলেও তেইশ বছর আগে মোটেও সহজ ছিল না। বৃষ্টির কারণে ধীরগতির আউটফিল্ড, ফাইনালে ওভারপ্রতি ৬ এর বেশি রান তাড়া করা, চাপটা ছিল টাইগারদের উপরই।
ইনিংস উদ্বোধন করতে নামলেন নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও ‘পিঞ্চ হিটার’ মোহাম্মদ রফিক। বাংলাদেশ শিবিরে দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল যখন প্রথম বলেই বোল্ড হয়ে ফিরলেন নাঈমুর। রফিক তার দায়িত্ব ঠিকমতোই পালন করলেন৷ ১৫ বলে ২ চার ও ২ ছয়ে ২৬ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলার পথে মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর সাথে অর্ধশত রানের জুটি গড়েন রফিক। নান্নু, আকরাম খান ও আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ছোট ছোট কিছু কার্যকরী ইনিংস জয়ের পথেই রাখে বাংলাদেশকে।
কিন্তু শেষদিকে দ্রুত কিছু উইকেট পড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১১ রান। হাতে দুই উইকেট। ক্রিজে খালেদ মাসুদ পাইলট ও হাসিবুল হোসেন শান্ত।
আগের ম্যাচে ৭০ রান করে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা পাইলট শেষ ওভারের প্রথম বলেই হাঁকালেন বিশাল ছক্কা। পরের বলে রান নিতে পারলেন না। এরপর হলো ওয়াইড। ৩য় বলে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক দিলেন শান্তকে। তিন বলে তিন।
পরের বলে শান্ত যেন চোখ বন্ধ করে মিড উইকেটের দিকে ব্যাট ঘোরালেন। কিন্তু ব্যাটে বলে হলো না। পরের বলে ভালো টাইমিং হলো। কিন্তু ধীরগতির আউয়ফিল্ডের কারণে বল বাউন্ডারিতে পৌঁছাল না। দুই রান নিলেন শান্ত-পাইলট।
শেষ বলে লাগে ১ রান। স্ট্রাইকে শান্ত৷ নন স্ট্রাইকে থাকা পাইলট প্রার্থনা করছেন, “আল্লাহ, আমার কাছ থেকে কোনো প্রিয় জিনিস কেড়ে নিয়ে হলেও বাংলাদেশকে জিতিয়ে দাও।”
মার্টিন সুজির করা শেষ বল টা গিয়ে লাগে শান্তর প্যাডে। চোখ বন্ধ করে পাগলাটে দৌঁড় দেন শান্ত। আম্পায়ার ‘না’ বলার ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন। ততক্ষণে ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে মালয়েশিয়ার কিলাত কেলাবে। রেডিওতে চৌধুরী জাফরুল্লাহ শারাফাত বা টেলিভিশনে হার্শা ভোগলে, বা ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরের প্রতিটা মানুষ ঘোষণা করছে যে, বাংলাদেশ জিতেছে। ১৯৯৭ এর আইসিসি ট্রফির চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। সারাদেশে সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আর এমন উদযাপন হয়নি কখনো৷ সম্ভবত বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতলে সেই উদযাপন ছাপিয়ে যাবে সবকিছুকে। সেটা কবে হবে, তা প্রশ্নবোধক চিহ্নের ভেতরেই থাকুক।