ফাঁসীর মঞ্চে সাধারনত একজন অপরাধী কে তার শেষ ইচ্ছার জিজ্ঞাসা করা হয়। তবে আজকের ঘটনাটি একটু ভিন্ন। একটু অন্যরকম।
শিকদার রানা (৩৪), ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়ে অন্যান্য ভাইদের সাথে পরিরারে হাল ধরতে জীবনের তাগিদে নারায়নগঞ্জ থেকে পাড়ি জমান সিংগাপুরে। ভালো ই চলছিল সবকিছু , শীপ বেকেং ইয়ার্ডের কাজ শেষে মা,পরিবার ও ৬ বছরের একমাত্র সন্তান ই যেন রানার শেষ আশ্রয় স্থল। কিন্তু হঠাৎ করেই এপ্রিল মাসের মাঝা মাঝি প্রচন্ড পেটে ব্যাথা ও বমি নিয়ে অসুস্থ হয়ে পরে সে’ । কাজের বিনিময়ে অর্থ – গোটা বিশ্বের রীতি। কাজ চালিয়ে যেতে থাকে, রানা কিন্তু, শরীর কি মনের কথা বোঝে। রোগের লক্ষন নিয়ে ভর্তি হয় সিংগাপুর জেনারেল হাসপাতালে। সমস্ত নিরীক্ষার আলোকে বাস্তবতায় চলে আসে এক নির্মম কষ্টকর সত্য – পাকস্থলির ক্যান্সার, তাও আবার শেষ পর্যায়ে। অর্থাৎ, রোগটি এতটা ই ছড়িয়ে গেছে যে, নিরাময়ে জন্য আর কোন চিকিৎসা নাই।
যে ভাগ্যকে প্রতিপক্ষ ভেবে ছোট কাল থেকে ই সংগ্রাম করে আসছে রানা, সে কিনা এক হাত দেখিয়ে ই দিল। ” জীবনে কেবল মাত্র সুখের ছোয়া পাইতে শুরু করছিল”। চিকিৎসা বিজ্ঞানে সম্মৃদ্ধ সিংগাপুরের মত দেশও এই রোগ মুক্তির অপারোগতার কথা জানিয়ে দেয়। জীবনের গুনগত মান বৃদ্ধি করার উদ্দ্যেশে কিছু চিকিৎসা চালিয়ে নিতে রানাকে, প্রশমন সেবা’র (প্যালিয়েটিভ কেয়ার) অধিনস্ত করা হয়।
জীবন সীমিতকারী রোগে আক্রান্ত মানুষদের শারিরীক ভোগান্তি কমানোর পাশাপাশি, পরিবারকে নিয়ে একটি সামগ্রিক – সামাজিক, মানুষিক ও আত্মিক সেবা নিশ্চিত করার নাম’ই প্যালিয়েটিভ কেয়ার। যেখানে রোগ ভালো করে দেয়ার চিকিৎসা নয় বরং রোগের কারনে সৃষ্ট সকল প্রকার কষ্ট ও ভোগান্তি কমিয়ে দেয়া সম্ভব এবং তা বিজ্ঞান সম্মত।
বিয়ে করে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে জীবনে আনন্দ যখন কড়া নাড়ছিলো ঠিক তখন ই সৃষ্টি কর্তার এমন পরীক্ষা যেন পুরো পরিবারটিকে থমকে দেয় । শেষবার সিংগাপুর ফিরে যাওয়ার সময় ৬ বছরের সন্তান বাবাকে বলেছিল ” আমার জন্য খেলনা কিনার জন্য ই কিন্তু তোমাকে জেতে দিচ্ছি”। সন্তানের এই আশা আজ আক্ষেপে পরিনত। রানার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল সন্তানের আশা পূরন না করতে পারার আবেগ।
রোগের এই পর্যায়ে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞগন সাধারনত এই মানুষ ও তার পরিবারকে নিয়ে জীবনের শেষ দিন গুলোকে সুন্দর ভাবে অতিবাহিত করার জন্য এক টি কর্ম পরিকল্পনা করে থাকে, যাকে কি না বলা হয় – এডভান্স কেয়ার প্ল্যানিং। এর ই ধারাবাহিকতায় রানা’র কাছে তার শেষ ইচ্ছার কথা জিজ্ঞাসা করা হলে রানা বলেন , ” মরতে যদি হয় ই, তবে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে আমার পরিবারে কাছে মরতে চাই- আমি আমার দেশে চলে যেতে চাই”।
এই ইচ্ছা পুরন করা হয়ত খুব একটা কঠিন কোন বিষয় ছিল না যদি এই চির চেনা পৃথিবীর চিত্র কোভিট ১৯ এ আক্রান্ত না হত। সিংগাপুর থেকে সকল ধরনের বিমান সেবা বন্ধ। সিংগাপুরের প্যালিয়েটিভ কেয়ারের অন্যতম পথদ্রষ্টা অধ্যাপক ডাঃ সিনথিয়া গোহ ও তার দল তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করেন সিংগাপুরে অবস্থানরত বাংলাদেশ কমিউনিটি ও মাইগ্রেন্ট ওয়ারকার এসোসিয়েশনের সাথে। এদের পাশে এসে দাড়ায় এশিয়া প্যাসিফিক হসপিস এন্ড প্যালিয়েটিভ কেয়ার এলায়েন্স। সকলের প্রচেষ্টায় একটি তহবিল গঠন করা হয়। সকলের উদ্দেশ্য এক টা ই ” ফুলফিল দা লাষ্ট উইস অব – সিকদার রানা”। খুব অল্প সময়ে কাংক্ষিত লক্ষ্যে পৌছে যায় সেই তহবিল। ভাড়া করা হয় একটি এয়ার এম্বুল্যান্স। সিংগাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সগন রানার ৬ বছরের ছেলের জন্য চকলেট, খেলনা সহকারে তৈরি করে দেন একটি ড্রিম ব্যাগ। আর জীবনের এই প্রান্তিক সময়টাকে সুন্দর ভাবে অতিবাহিত করার জন্য হাতে গুজে দেন কিছু অর্থ। এ যেন মানবতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরন। মানুষের ভালোবাসায় পরাজিত হয়েছে সকল বাধা।
বাংলাদেশের সাথে এশিয়া প্যাসিফিক হসপিস এন্ড প্যালিয়েটিভ কেয়ার এলায়েন্স (APHN) এর একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বেশ অনেক আগে থেকেই । সেই বুন্ধত্বের জের ধরে, অধ্যাপক সিনথিয়া, বাংলাদেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের পুরোধা অধ্যাপক নিজামুদ্দিন আহমদ কে সাথে রেখে সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার -বংগবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় ক্যান্সার ও গবেষনা ইন্সটিটিউট (সহকারী অধ্যাপক ডাঃ লুবনা মরিয়ম), ইউনাইটেড হাসপাতালের পক্ষ থেকে ডাঃ রুমানা দোউলা, হস্পিস বাংলাদেশ ( ডাঃ শাহিনুর কবির) , আশিক ফাউন্ডেশন ( সালমা চৌধুরী ) – সবার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। একটি ওয়াটস’ আপ গ্রুপ তৈরি করা হয়, নাম দেয়া হয় – BACK TO HOME.
সিংগাপুর ও বাংলাদেশের সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গত ২২শে মে,২০২০ রাত ১১ঃ৪৫ মিনিটে, সিকদার রানা কে নিয়ে একটি ভাড়া করা এয়ার এম্বুল্যান্স বাংলাদেশের মাটিতে অবতরন করে। এয়ারপোর্টে রানা’র সেই আবেগী চোখগুলো যেন তার সন্তানকে আকড়ে ধরতে চুমু খেতে চাচ্ছিলো। পরিবারে সবাই তখন অপেক্ষমান সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার, বংগবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার শেষ ইচ্ছা অনুজেই, সে ফিরে এলো তার পরিবারে মাঝে, নিজ দেশে। জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে, রানা ও তার পরিবারের সকল ধরনের চিকিৎসাগত সামগ্রিক সেবার দ্বায়িত্ব নেয় সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার, বংগবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এর সাথে বাংলাদেশের সকল প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রদানকারী অংগসংস্থাসমুহ।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এই ধরনের উদাহরন- খুব একটা বিরল না হলেও বাংলাদেশের মত একটি গরীব দেশের একজন খেটে খাওয়া শ্রমীকের জন্য এই উদাহরন আমাদের কে শেখায় – পৃথিবীতে মানবতা বলে এখনো কিছু অবশিষ্ট আছে। ভালোবাসা মরে যায়নি। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা , সিংগাপুর জেনারেল হাস্পাতালের প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগ ও অধ্যাপক সিনথিয়া গো- র প্রতি। এক ই সাথে এশিয়া প্যাসিফিক হসপিস এন্ড প্যালিয়েটিভ কেয়ার এলাইন্স, মাইগেন্ট ওয়ারকার্স এসোসিয়েশন অব সিংগাপুর ও সকলে যারা এই মহৎ কাজে এগিয়ে এসছেন। এক ই,সাথে বাংলাদেশ দূতাবাস সিংগাপুর, সিভিল এভিয়েশান বাংলাদেশ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রত্যকে যারা প্রতোক্ষ্য ও পরোক্ষ ভাবে রানা’র শেষ ইচ্ছা পুরোনে এগিয়ে এসছে।