সাজেক নিয়ে আজকে যে গল্পটা বলবো সেটা রুপকথার মত কোন গল্প নয়, সত্যি সত্যিই সেটা একটা রুপকথা মনে হবে সবার কাছে। যে গল্প আজকাল কেউই সহজে বিশ্বাস করতে চাইবেনা। কারন সবার কাছে এটা মনগড়া বা রুপকথা মনে হবে। সাজেকের রুপকথা বা রুপকথার সাজেক! তাই আমার গল্পের নাম সাজেক ও একটি রুপকথার গল্প! তো শুরু করা যাক সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে অবাক করার রুপকথার গল্পটা।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, এই সাত বা আট বছর আগে হবে হয়তো, যখন সাজেক নামটাও অনেকে জানতো না। সেটা কোথায়, কি আছে, কিভাবে যেতে হয়, কত ভাড়া, থাকা যায় কিনা, কি খাবার পাওয়া যায় এসব জানা অনেক দূরের ব্যাপার ছিল। জানবে কি করে সাজেক নামে যে কিছু একটা আছে, পাহাড়, মেঘ, বৃষ্টি, সকালের সুর্য উদয় আর বিকেলের মায়াবী গোধূলী যে এখানে একটু অন্য রকম সেটা জানতো কেউই।
হ্যা সেই সময়, যখন কেউ নাম জানতো না, কেউ চিনতো না, কেউ ক্রেজি ছিলোনা এখানে যেতে, কেউ এই যায়গা নিলে লুট পাটের ব্যবসা করতোনা, সেই চিন্তাই যখন কেউ করেনি তখন প্রথম সাজেক গিয়েছিলাম। এতো আর এতোটাই রুপকথার মত শোনাবে বাকি গল্পটা যে সবাই অবাক হয়ে যাবে। যার মধ্যে প্রথম হল, খাগড়াছড়ি গিয়ে জানতে পারলাম সেখান থেকে সাজেক যাওয়ার কোন উপায় নেই!
সাজেক যেতে হলে আগে বাসে করে দিঘিনালা যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে সাজেক যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে! মাই গড! বলে কি! ভয়ে সেদিন আর সাজেক যাওয়ার চেষ্টাই করলাম না। সেদিন খাগড়াছড়িতে থেকে গিয়েছিলাম এক কলিগের বাড়িতে।
সারাদিনের জন্য একটা সিএনজি ভাড়া করেছিলাম ৬০০ টাকা দিয়ে! তারপর আলুটিলা, রিসাং ঝর্ণা, বাজার, ব্রিজ, পার্ক আরও কত কি যেন ঘুরে ঘুরে দেখাতে চেয়েছিল সিএনজিওয়ালা। কিন্তু রিসাং এর উম্মত্ততায় ক্লান্ত হয়ে বেশি না ঘুরে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় হেটে বেরিয়েছিলাম। রাতে কলিগের বাড়িতে ঘুমিয়ে খুব সকালে বেড়িয়ে পরেছিলাম সাজেক যাবার সিএনজি খুঁজে পেতে। তখনো চাঁদের গাড়ি তেমন একটা চলাচল শুরু করেনি সাজেকের দিকে। হয়তে সপ্তাহে দুই একটি যায় আসে!
তো খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাওয়ার উপায় না পেয়ে, বাসে করে দীঘিনালা চলে গিয়েছিলাম। সেখানে সকালের নাস্তা করে একটা সিএনজি ঠিক করেছিলাম ২০০০ টাকায়। যাবে রাতে থাকবে আবার পরদিন নিয়েও আসবে! জি মাত্র ২০০০ টাকায়, যাত্রী ছিলাম আমরা তিন কলিগ আর খাগড়াছড়ির কলিগের আর এক কাজিন। সেই চারজন মিলে, হেলেদুলে, ইচ্ছেমত থেমে চলে, যেখানে সেখানে দাড়িয়ে, ঘুরে ছবি তুলে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগিয়ে পৌছে ছিলাম সাজেক নামক আজকের ক্রেজে। কিন্তু আমাদের কাছে এর চেয়েও অবাক লেগেছিল কি জানেন?
জেনে অবাক হবেন বা হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না। সেটা হল....
সাজেক গিয়ে সিএনজি থেকে নেমে দেখি আমরা চারজন ছাড়া কোথাও কোন মানুষ নেই! একটা কুকুর পর্যন্ত নেই! আজকাল নাকি শুনি শুধু কুকুরের ছড়াছড়ি! কুকুর থাকবে কি করে বলুন? মানুষ যেহেতু নাই, পোলাও, বিরিয়ানি, গোস্ত, মুরগির রান, খাসির রেজালা খাবার কেউ তো ছিলোনা। নানা যায়গায় নানা রকম খাবারের প্যাকেটও পরে থাকতোনা, তাই কুকুরও দেখা যেতনা! তবে হ্যা....
সাজেকে তখন কুকুর দেখা না গেলেও অনেক অনেক পাখির দেখা পাওয়া যেত! নানা রকম নাম না জানা পাহাড়ি পাখির কত রকমের যে কিচিরমিচির শোনা যেত বলে বোঝানো যাবেনা জানেন। আর পুরো সাজেকের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত মাত্র একটা বাসের মাচার মত ঘর ছিল। যেখানে অনেক বলে কয়ে আমরা খাবারের ব্যবস্থা করিয়েছিলাম। তাও আমাদের সাথে খাগড়াছড়ির স্থানীয় দুজন ছিল বলে! ও হ্যা জানেন তো তখন সাজেকে রাতে থাকার জন্য মাত্র ১০০ টাকা লাগতো! জি ১০০ টাকা মাত্র! আমাদের জনপ্রতি সাকুল্যে খরচ হয়েছিল কত জানেন? ২৩৫০/-!! জি ঠিক দেখছেন ২৩৫০/- রুপকথার মত মনে হচ্ছেনা বলুন?
সাজেকে কেউ নেই, কোন কুকুর, বেড়াল ছিলোনা, কোন মানুষ ছিলোনা আমরা কয়েকজন ছাড়া! ছিলোনা কোন কটেজ, হোটেল, মোটেল বা আলোঝলমলে রাতের আয়োজন। সেখানে ছিলাম শুধু আমরা, নিরব নির্জন পাহাড়, নিখাদ সবুজ, ঘন অরণ্য, মেঘ কুয়াশার মাখামাখি, নীল নীল নীল আকাশ আর ছিল চেনা অচেনা নানা রকম পাখির কলরব! ভাবতে পারছেন বলুন যে আপনি, পাখির কিচিরমিচির, সবুজ পাহাড়, আর মেঘ কুয়াশার মাখামাখি ছাড়া সাজেকে আর কিছু নেই! আর সেখানেই নাকি রাতে থাকতে ১০০ টাকা লাগতো! রুপকথার মত লাগছেনা শুনতে বলুন?
আর আজকাল নাকি সাজেকে থাকতে ৮০০০ টাকাও লাগে বলে শুনছি! উফফস, তাও নাকি দুই তিন বা চার মাস আগে বুক করে রাখতে হয়! আর আজকাল নাকি সাজেকে প্রচুর কুকুর আছে, চারদিকে নাকি নানা রকম লোভাতুর খাবারের ঘ্রাণ আর সেই ঘ্রাণ ও খাবারের লোভে নাকি প্রচুর ঘেউ ঘেউ চলতে থাকে রাত দিন সব সময়! হবেই বা না কেন? এমন অমানুষের মত পাহাড়, অরণ্য, মেঘ কুয়াশাকে বিরক্ত আর চারপাশ নোংরা করে রাখলে তো সেই লোভে কুকুর বেড়াল আসবেই!
আমার তো ভাই এসব গল্প শুনে রুপকথার মত লাগে! মনে হয় এসব কিছুই সত্যি নয়, কোন রুপকথার গল্প যেন! নাকি আমার বলা শুরুর গল্পটা আপনাদের কাছে রুপকথার গল্প মনে হল? কে জানে রুপকথার গল্প তো বটেই যে কোন একটা।
হয় কুকুর বেড়ালহীন শুধু পাহাড়, অরণ্য, মেঘ কুয়াশায় ঘেরা আর একটা বাশের মাচা থাকা দুই চারজন মানুষের সেই সাজেক! অথবা মানুষে গিজগিজ করা, কটেজ, মটেজ, হোটেলে সারাক্ষণ খাবারের জন্য জিভের লালা ফেলে ঘেউ ঘেউ করতে থাকা কুকুর বা বেড়ালে ভরা সাজেক!
কোনটা যে কার কাছে রুপকথা বোঝা মুশকিল। তবে, আপনার আমার সবার কাছে আসলেই সাজেক একটা রুপকথার গল্প!
৩১ অক্টোবর ২০২০
যখন সাজেক ফাকা ছিল আর সাজেকে যেদিন একাই ছিলাম!
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ মোঃ পলাশ শিকদার