মো. পলাশ শিকদারঃ সনাতন ধর্মালম্বীদের দুদিনব্যাপী মহাষ্টমী পুণ্যস্নান উৎসব শেষ হয়েছে গতকাল। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের আদি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এ স্নানোৎসব পালন করা হয়। পুণ্যস্নানের লগ্ন শুরু হয় সোমবার (১৫ এপ্রিল) বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে। আর শেষ হয় মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) বিকেল ৪টা ৫৬ মিনিটে। এ সময় ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল ও ভুটানসহ দেশি বিদেশি কয়েক লাখ পুণ্যার্থী স্নানোৎসবে মেতে উঠে। এবার লাঙ্গলবন্দে স্নানোৎসব সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পাদন করতে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জেলা পুলিশ।
‘হে মহা ভাগ ব্রহ্মপুত্র, হে লৌহিত্য আমার পাপ হরণ কর’-এ মন্ত্র উচ্চারণ করে পাপ মোচনের আশায় ব্রহ্মপুত্র নদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা স্নানোৎসবে অংশগ্রহণ করে। স্নানের লগ্ন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যার্থীরা ডাব, দুর্বা, বেলপাতা ফলমূলসহ বিভিন্ন পূজার সামগ্রী নিয়ে পুণ্যস্নানে আদিকাল থেকেই অংশ করছেন। দুদিনব্যাপী এ স্নানোৎসবে পুণ্যার্থীর ঢল নামে পুরো তীর্থস্থানের এলাকাজুড়ে। পাপমোচনের আশায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পুণ্যার্থীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে লাঙ্গলবন্দ।
জানা যায়, ব্রহ্মপুত্রের জলের মাধ্যমে পাপমুক্ত হয়েছিলেন বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম মুনি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, মহাভারতের বর্ণনামতে পরশুরামমুনি পাপমুক্তির জন্য ব্রহ্মপুত্র নদে যে স্থানের জলে স্নান করেছিলেন, তা লাঙ্গলবন্দে অবস্থিত। সেই থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস এ সময়ে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান খুবই পুণ্যের। এ স্নানের ফলে ব্রহ্মার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে পাপমোচন হয়। এ বিশ্বাস নিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে পরশুরামের পাপ থেকে মুক্তি হওয়ার কথা স্মরণ করে শত শত বছর ধরে লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমী স্নান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
লাঙ্গলবন্দ মহাষ্টমী স্নান উদযাপন কমিটি সূত্রে জানা যায়, এবার ২০টি স্নান ঘাট পুণ্যার্থীদের জন্য সংস্কার করা হয়েছে। বিশুদ্ধ খাবারের জল সরবরাহের জন্য ১৬টি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। বিপুলসংখ্যক কাপড় পরিবর্তন কক্ষ ও ১৫০টি অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ করেছে জেলা প্রশাসন, এ ছাড়া নদের কচুরিপানা অপসারণ করা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, ৫টি মেডিকেল টিম ও ১০ শয্যাবিশিষ্ট অস্থায়ী হাসপাতালের ব্যবস্থা করেছে নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস। সেই সঙ্গে স্নানে আসা দর্শনার্থীদের সেবা নিশ্চিতে বেসরকারিভাবে ৬০টি সেবাক্যাম্প ও ৪০০ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেছে। এ ছাড়া পুরো ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১০০টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এদিকে নৌপুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ উৎসব ঘিরে কাজ করেছে। এবারও স্নানোৎসব ঘিরে রাস্তার দুপাশেই বসেছে লোকজ মেলা।
যেসব ঘাটে পুণ্যার্থীরা স্নান করেছে সেগুলো হলো- ললিত সাধুর ঘাট, নাসিম ওসমান কেন্দ্রীয় স্নানঘাট, গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া স্নানঘাট, জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি স্নানঘাট, অন্নপূর্ণা স্নানঘাট, লাঙ্গলবন্দ রাজঘাট, মাকরী সাধুর শান্তি আশ্রম স্নানঘাট, গান্ধী ঘাট বা মহাশ্মশান স্নানঘাট, বরদেশ্বরী কালী ও শিব মন্দির স্নানঘাট, জয়কালী মন্দির স্নানঘাট, রক্ষা কালীমন্দির স্নানঘাট, পাষান কালীমন্দির স্নানঘাট, স্বামী দ্বিগিজয় ব্রক্ষচারী আশ্রম প্রেমতলা, শ্রী রামপুর জগদ্বন্ধু স্নান ঘাট (ব্রক্ষা মন্দির), দক্ষিণেশ্বরী কালী মন্দির স্নানঘাট,পরেশ মাহাত্মা আশ্রম স্নানঘাট, সাব্দী রক্ষা কালীমন্দির স্নানঘাট, সাব্দী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম স্নান ঘাট ও পঞ্চ পান্ডব স্নানঘাট (কালীগঞ্জ ঘাট) ও শ্রী প্রভুপাদ স্নানঘাট।
ভারতের বর্ধমান থেকে আগত বৃদ্ধা তুলশী দেবী বলেন, ‘শেষ বয়সে এখানে এসে শান্তিতে স্নান করতে পেরেছি, এতেই আমি খুশি।’ চট্টগ্রাম থেকে আসা গোপাল বিশ্বাস বলেন, ‘আমি পরিবারের ৮ সদস্যকে নিয়ে লাঙ্গলবন্দে এসেছি। কোনো ঝামেলা ছাড়াই এবার রাজঘাটে স্নান সম্পন্ন করেছি।’
এ বিষয়ে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিখন সরকার শিপন বলেন, এবার স্নানোৎসব শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটানসহ দেশ বিদেশের পুণ্যার্থীরা অংশগ্রহণ করেছে। তিনি জানান, ছয়-সাত বছরের মধ্যে এবার পুণ্যার্থীর আগমন বেশি হয়েছে। এবার ১০ লাখের বেশি দর্শনার্থী এ স্নানোৎসবে অংশ নিয়েছে।
আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, হিন্দুধর্মীয় মতে, ত্রেতাযুগে বাবার আদেশ পালনে কুড়াল দিয়ে মাকে হত্যা করেন পরশুরাম। এ সময় তাঁর হাতে ওই কুড়াল আটকে যায়। এরপর পাপমোচনের জন্য তিনি বহু তীর্থস্থান ঘুরেও কোনো ফল পাননি। অবশেষে চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে ব্রহ্মপুত্র নদের লাঙ্গলবন্দে স্নান করে তাঁর পাপমোচন হয়। এরপর থেকে এই তিথিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ পাপমোচনের জন্য মন্ত্র পড়ে কলাপাতায় ফুল ও ফল নদীতে ভাসিয়ে গঙ্গা দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন।