আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে গভীর বেদনা ও শোকের একটি দিন। ১৯৭১ সালের এ দিনে বিজয়ের ঊষালগ্নে স্বাধীনতার শত্রুরা হত্যা করে জাতির অনেক কৃতী সন্তানকে।
এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের মাত্র দু’দিন পরই তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন। পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের পর চার দিকে যখন বিজয়ের রব, মুক্ত পরিবেশে মানুষ যখন রাস্তায় বের হয়ে আসতে শুরু করেছে, ঘরে ফিরতে শুরু করেছে, বিজয়কে বরণের আনন্দে দুলছে ঠিক তখনই এক শোকাবহ ঘটনার অবতারণা ঘটায় স্বাধীনতার শত্রুরা। পরিপূর্ণ বিজয়ের আগ মুহূর্তে জাতির মেধাবী সন্তানদের তারা বাসা থেকে ধরে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার বরেণ্য ব্যক্তিত্ব তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পীদের হত্যা করা হয় বেছে বেছে; যাতে এ জাতি স্বাধীনতা পেলেও আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। তাদেরকে ধরে নিয়ে রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ এলাকা ও মিরপুরে জড়ো করে হাত-পা ও চোখ বেঁধে হত্যা করে লাশ ডোবার মধ্যে ফেলে রাখা হয়; যা এখন বধ্যভূমি নামে পরিচিত। হানাদার বাহিনী তাদের পরাজয় আসন্ন জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পনা করে। ১৪ ডিসেম্বর তাই আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এ উপলক্ষে পৃথক বাণী প্রদান করেছেন।
বুদ্ধিজীবী নিধন প্রক্রিয়ায় যারা চিরকালের জন্য নিখোঁজ হয়েছেন এবং বধ্যভূমিতে যাদের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ডা: ফজলে রাব্বী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. জেসি দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ডা: আলিম চৌধুরী, সাংবাদিক-সাহিত্যিক সিরাজউদ্দিন হোসেন, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদ, লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, আলতাফ মাহমুদ, রশীদুল হাসান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, সায়ীদুল হাসান, সেলিনা পারভীনসহ আরো অনেকে।
১৪ ডিসেম্বরের আগে থেকেই বেশ কিছু নামকরা বুদ্ধিজীবী নিখোঁজ হতে থাকেন। তবে ওইদিন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। জাতির সেসব কৃতী সন্তানদের স্মরণে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে এবারো গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় জাতি স্মরণ করবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি। এ ছাড়া রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভে প্ুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হয় শহীদদের।
স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। তরুণ এই চলচ্চিত্রকার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার রহস্য উদঘাটনের। তার সংগ্রহে মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক অমূল্য প্রামাণ্যচিত্র ছিল। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে জহির রায়হানের অন্তর্ধান আজো একটি বিরাট রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে, কারা কেন তাকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে সে বিষয়ে।