“রক্তিম প্রভাত”

চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন, সাথে স্নিগ্ধ শীতল বায়ু। ঠিক যেনো গাঁয়ে শিহরণ লাগার মতো। ওদিকে পুবের অন্তরীক্ষে রক্তিম সূর্য কুয়াশা ভেদ করে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে কুয়াশাগুলো যেনো নিমিষেই মাটির উপরের ঘাসগুলোতে জলকণা হয়ে ঝরে পড়ছে। প্রতিটি জলকণা মিশে তৈরি করছে ফোঁটা ফোঁটা শিশির।

পাকা ড্রেনের দু’পাশের জমিগুলোতে সারি সারি গোলাপের চারা। যেনো প্রকৃতির সব সৌন্দর্য, প্রেম আর মহত্ত্বের চিহ্ন স্বরূপ চারা গাছের মাথায় নিজের রূপের মূর্ছনা উজাড় করে দিয়ে ফোটে আছে প্রতিটি গোলাপ। লাল গোলাপে রঙিন চারিপাশ। প্রতিটি পাঁপড়িতে লেগে আছে শিরিরের ছোঁয়া। গোলাপের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে শিশিরগুলো যেনো মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।

ড্রেনের দু’পাশ থেকে হাতে হাত রেখে খুব আনন্দ নিয়ে শীতের সকালটা উপভোগ করছে তারা। ছেলেটার পড়নে নীল রঙের পাঞ্জাবি আর কাঁধে একটা চাদর জড়ানো। মেয়েটার পড়নে একটা লাল শাড়ী, একটা চাদর আর মাথায় একটা গোলাপ ফুলের তৈরি রিং।ঠিক যেনো আকাশ থেকে সদ্য নেমে আসা একটা লাল পরী। দুজনে হাতে হাত রেখে হাটছে আর মনের সুখে প্রেম সঙ্গীত গাইছে। যেনো স্বর্গীয় সুখের ঝাপসা উপস্থিতি আজ পরিবেশটাকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছে। প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাইতো এমন সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

পরক্ষণেই হঠাৎ পা পিছলে ড্রেনের মাঝে পড়ে গেলো আবীর। ধপাস করে একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ হলো।ততক্ষণে আবীর নিজেকে আবিষ্কার করলো, সে খাট থেকে নিচে পড়ে গেছে। এদিকে এতো রাতে আকষ্মিক পড়ে যাওয়ার শব্দ শোনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আয়েশার। তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে ওঠেই কি হয়েছে বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো এবং দেখলো খাট থেকে নিচে পড়ে আছে আবীর। ততক্ষণে বুঝতে আর বাকী রইলো না। লজ্জায় আবীবের মুখ লাল হয়ে গেলো।দুজনের মুখে আহ কি বাঁধভাঙা হাসি! কি হয়েছে জানতে চাইলে, আবীর তার স্বপ্নের বিস্তারিত বললো।সবকিছু শোনে আয়েশা একটা পরম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললো, জানো আবীর, আজকে কিন্তু আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। চলোনা স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিই। কথাটা শোনে আবীবের মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো। দুজনেই ইচ্ছা পোষণ করলো যে, তারা স্বপ্নে দেখা সেই গোলাপ রাঙা প্রভাতটা এমন শুভ দিনে উপভোগ করবেই। প্রকৃতির এমন চমৎকার সৌন্দর্য প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে উপভোগ করার মতো এমন সুযোগ যখন আসে তখন সেটাকে কাজে লাগাতে কেবা না চায়।

যেই কথা, সেই কাজ। খুব সকাল বেলা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো আবীর ও আয়েশা। বাসা থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে একটি এলাকা যেখানে গোলাপের চাষ করা হয়। তারা সেখানে গিয়ে আজ তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করবে এবং একটি গোলাপ রাঙা প্রভাত উপভোগ করবে। তর সইছে না করোরই। আবীবের পেছনে বসে আয়েশা তার কানে কানে ফিসফিস করে বলছে, জানো আবীর, আজ কেনো জানি পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছা করছে আকাশের ঐ ভাসা ভাসা মেঘগুলোকে ছুঁয়ে আসি। আবীর শোনে আর মুচকি মুচকি হাসে। আজ সে মনে মনে ভাবছে আয়েশার মতো এমন কাউকে জীবনসঙ্গিনী পেয়ে সে সত্যিই খুব ভাগ্যবান। তাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক সত্যিই পূর্ণতা পেয়েছে।

পরক্ষণেই হঠাৎ করে রাস্তার অপর পাশ থেকে আসা একটা বেপরোয়া ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে যায় বাইকটির। মুহূর্তেই সব আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন আর আনন্দের সন্ধিক্ষণ পরিণত হলো চরম বিষাদে। রাস্তার দু’পাশে পড়ে আছে দুটি নিথর, প্রাণহীন দেহ আর জরাজীর্ণ বাইকটি। নীরবতা আর স্তব্ধতায় জড়িয়ে গেলো চারিপাশ। ঠিক যেনো বিষাদের অভয়ারণ্য।

হয়তো তারা গোলাপ রাঙা একটা প্রভাত উপভোগ করতে পারেনি,পারেনি তাদের বাকী জীবনটা একসাথে কাটাতে।হয়তো ফিরে আসবে না তাদের আর কোনো বিবাহবার্ষিকী, দেখবে না অপূরণীয় কোনো স্বপ্ন। তবে চাই, পৃথিবীর বুকে এমন ভালোবাসার জয় হোক, সুদীর্ঘকাল ধরে বেঁচে থাকুক ভালোবাসায় সিক্ত প্রাণগুলো। পূরণ করুক সকল স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্খা। আর মরে গিয়ে হোক স্বর্গীয়।

লেখক
কাজী শফিকুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: Content is protected !!